আপনার Kidney ভালো আছে তো?

নভেম্বর ১, ২০১৫

মানবদেহের শরীরের প্রতিটি অঙ্গের কাজ ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের এই শরীরে রয়েছে শ্বাসনালী, হার্ট, লিভার, পাকস্থলি, কিডনি, অগ্নাশয়, গলব্লাডার, খুদ্রান্ত, বৃহদান্ত ইত্যাদি। আর এই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রন করে ব্রেইন। প্রতিটি অঙ্গের কাজ আলাদা করে ভাগ করে দেয়া আছে। এদের সবার কাজ আলাদা হলেও, এরা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটা টিম। মানবদেহের এই অঙ্গগুলো কিছু নিয়মের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। আর এই নিয়মের ব্যাতিক্রম হলেই আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি।

আমাদের শরীরের অন্যতম একটি অঙ্গ কিডনি (Kidney)। কিডনির প্রতি অযত্ন বা অনিয়মের ফলে শুধু অসুস্থবোধই না, জীবন হুমকির মুখে পরতে পারে যে কোন বয়সে।

কিডনির কাজ এবং ভুমিকা – আমাদের শরীরে যে দুটো Kidney আছে তাদের কাজ হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধিত করে শরীরকে সুস্থ রাখা। দুটো কিডনিতে প্রায় ২০-২৫ লাখ ছাঁকনি রয়েছে, যা অনবরত রক্তকে পরিশোধিত করে যাচ্ছে। কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, রক্তস্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে এবং অস্থিগুলো শক্তিশালী করে থাকে।

কিডনি রোগের অন্যতম কারণগুলো – কিডনি রোগের অন্যতম কারণ কিডনির প্রদাহ। High Blood Pressure ও Diabetes নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হতে পারে এই রোগ। আবার যাঁদের রক্তচাপ অতিরিক্ত কম থাকে, তাঁদেরও হঠাত্ খারাপ হতে পারে কিডনি। কিডনির রোগে আক্রান্তরা শুরুর দিকে সমস্যা টের পান না। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুরুর দিকে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, বমি, পায়ে পানি আসা-এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। সেজন্য উপরোক্ত যে কোনো লক্ষণ দেখা দিলে আপনার উচিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির অবস্থা জেনে নেওয়া। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে রয়েছে প্রস্রাব পরীক্ষা ও রক্তে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ নির্ণয় করা।

কিডনির প্রধান রোগ নেফ্রাইটিস বা Nephritic Syndrome , যা কিডনির ছাঁকনি বা ফিল্টার মেমব্রেনকে ক্ষতবিক্ষত করে। এর কারণে শরীর থেকে অত্যাবশ্যক Protein বেরিয়ে যায়। প্রস্রাব প্রদাহ কিডনির একটি সাধারণ রোগ হলেও শিশুদের ক্ষেত্রে মারাত্মক হতে পারে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগ নয়, তবু কিডনিকে আক্রান্ত করে কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করে। যেসব রোগ কিডনিকে আক্রান্ত করে কিডনির কার্যকারিতা বিনষ্ট করে বা কিডনি ফেইলুর হয়:
১. Nephritis ২. Diabetes ও ৩. High Blood Pressure

কিডনি যে যে কারনে ঝুঁকিপুর্ন হয়ে পরে – কিডনি রোগ বংশানুক্রমিক হতে পারে। বয়স যদি ৪০ বছরের ওপরে হয় এবং যদি Diabetes বা Blood Pressure ভুগে থাকে কেউ অথবা বংশে যদি কিডনি রোগ থাকে, তবে অবশ্যই তাকে রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করে জেনে নিতে হবে কিডনি রোগ আছে কি না। Antibiotic ও Painkiller ওষুধের ব্যবহার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কিডনি রোগের কারণ হতে পারে। আকস্মিক কিডনি বিকল রোগে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা অনেক রোগীকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে। অতিরিক্ত Diarrhea , Vomit ও Bleeding আকস্মিক কিডনি বিকল হওয়ার প্রধান কারণ। মেয়েদের গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ পরবর্তী পর্যায়ে কিডনি রোগের কারণ হতে পারে। Nephritis , Diabetes, High Blood Pressure ৮০% ক্ষেত্রে কিডনি বিকলের কারণ।

কিডনি রোগের প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা – দুটো কিডনি ৯০ শতাংশ অকেজো হওয়ার পরই কেবল Dialyses বা Kidney Transplant প্রয়োজন হয়। জীবিত অবস্থায় একটি কিডনি কেবল মা-বাবা, ভাইবোন, ছেলেমেয়েকে নির্ভয়ে দান করতে পারেন। তাঁদের ভেতর রক্তের গ্রুপ বা টিস্যু টাইপ না মিললে তখন আপন চাচা, মামা, ফুফু, খালা বা স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে কিডনি দান করতে পারে। মৃত ব্যক্তি (ব্রেনডেথ-ভেন্টিলেটরে থাকা অবস্থায়) আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাইকে কিডনি দিতে পারে। ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী কিডনি রোগে ভোগে থাকে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ রোগীর কিডনি অকেজো হতে পারে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখলে কিডনি রোগ থেকে রেহাই পাবার সম্ভাবনা আছে। শুধু রক্তচাপ, প্রস্রাব পরীক্ষা এবং রক্তের ক্রিয়েটিনিন ও সুগার পরীক্ষা করেই জানা যায় কিডনি রোগ আছে কি না। কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেলে ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজনই হলো বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। শিশুদের টনসিলাইটিস, প্রস্রাবে প্রদাহ ও চর্মরোগের তাত্ক্ষণিক চিকিৎসা করুতে হবে।

যারা কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে চান, তাদের জন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা Diet এবং Balanced খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচার মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। কিডনি সুরক্ষায় বিশেষ কিছু খাদ্য হিসাবে এরকম কিছু খাবারকে নিশ্চিত করেছে বিশেষজ্ঞরা, যেগুলো মেনে চললে কিডনি সমস্যার ঝুঁকি কমবে।

ক্যাপসিকাম: কিডনি সুস্থ রাখতে ক্যাপসিকাম খুবই কার্যকর। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, বি৬, ফলিক এসিড এবং ফাইবার। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ এন্টিঅক্সিডেন্ট লাইকোপিন এর প্রধান উপাদান, যা কিনা ক্যান্সার প্রতিরোধেও সহায়ক।
বাধাকপি ও ফুলকপি: বাধাকপি ও ফুলকপিকে এন্টিঅক্সিডেন্ট এর খনি বললেও ভুল হবে না। এরা শরীরের ক্ষতিকারক ফ্রি রেডিকেলস এর বিরুদ্ধে কাজ করে আপনার কিডনিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ক্যান্সার এবং হৃদরোগ প্রতিরোধেও কাজ করে। দামে সস্তা হলেও এতে রয়েছে ভিটামিন কে,সি,বি৬,ফলিক এসিড। প্রচুর ফাইবার সমৃদ্ধ বাধাকপি হতে পারে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার অন্যতম উপাদান। ফুলকপির একটি বিশেষগুণ হলো এটি শরীর থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান দূর করতে সহায়তা করে।
রসুন: রসুনের গুণের কথা সবারই জানা। এটি কিডনি প্রদাহ উপশম করার পাশাপাশি রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। কিডনি রোগীদের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
পেঁয়াজ: পেঁয়াজের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ফ্লাভনয়েড, যা রক্তনালীতে চর্বি জমা প্রতিহত করে। এর এন্টিঅক্সিডেন্ট কিডনি জনিত উচ্চরক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। ক্যান্সার প্রতিরোধেও এর ভূমিকা রয়েছে।
ডিমের সাদা অংশ: আমরা অনেকেই স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ডিমকে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেই। কিন্তু ডিমের সাদা অংশই হচ্ছে বিশুদ্ধ প্রোটিন, যা কিডনির জন্য খুবই দরকারি।
মাছ: মাছকে বলা হয়ে থাকে নিরাপদ প্রোটিনের উৎস। দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মাংসের চেয়ে মাছের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি মাছে রয়েছে ওমেগা ৩ যা কিডনি, হার্ট এবং লিভারের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী। এছাড়াও কোলেস্টেরল কমাতে এর ভূমিকা রয়েছে।
লাল আঙুর: এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ফ্লাভনয়েড, যা কিডনিকে রাখে সদা তরুণ। এটি রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
আপেল: বলা হয়ে থাকে প্রতিদিন একটি করে আপেল খেলে ডাক্তার থেকে দূরে থাকা যায়। নিয়মিত আপেল খাওয়ার অভ্যাস করলে তা কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও রক্তে কোলেস্টেরল কমাতে, হৃদরোগ এবং ক্যানসার প্রতিরোধেও এর ভূমিকা অনন্য।
অলিভ ওয়েল: গবেষণায় দেখা গেছে যেসব দেশে অন্যান্য তেলের চেয়ে অলিভ ওয়েল বা জলপাই এর তেল ব্যবহার করা হয় সেসব দেশে কিডনি রোগী, হৃদরোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি তুলনামূলক কম হয়। অলিভ ওয়েলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পলিফেনল যা এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে চমৎকার কাজ করে। রন্নায় অথবা সালাদে অলিভ ওয়েল ব্যবহার বাড়তি স্বাদ যোগ করে।

কিডনি রোগ প্রতিরোধ ও সে রোগ থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য লাইফস্টাইল সম্পর্কে নিম্ন কিছু টিপস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

নিয়মিত শরীর চর্চা: সময় পেলেই হাঁটুন, সম্ভব হলে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের জন্য সাইকেলকে বেছে নিন। সাইক্লিং, শহুরে জীবনে খোলা পরিবেশে গোসল বা সাঁতার কাটান। কর্মঠ ও সতেজ শরীরে অন্যান্য রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার মত কিডনির রোগের সম্ভাবনাও কমে যায়।
ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অধিকাংশই কিনা কিডনি রোগে ভুগেন। রক্তের চিনি যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে কিডনি রোগ নিয়ে আপনি প্রায়ই চিন্তিত থাকেন। তাই নিয়মিত রক্তের চিনি পরীক্ষা করার পাশাপাশি অন্তত তিনমাসে একবার করে আপনার কিডনি পরীক্ষা করান, দেখুন সবকিছু স্বাভাবিক আছে কিনা। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। অনেকের মতে রক্তচাপ শুধু ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের কারণ। আসলে কিন্তু তা নয়। কিডনি ফেইলিওর এর পেছনেও কারণ হিসেবে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ। রক্তচাপ ১২৮/৮৯ এমএম (millimeters of mercury) এর বেশি হলেই আমাদের ডাক্তার দেখাতে হবে। রক্তচাপ সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখা মানে আপনার কিডনিকেও সুস্থ রাখা।
পরিমিত আহার : অতিরিক্ত কোন কিছুই শরীরের জন্য ভাল নয়। সেজন্য আমাদের খেয়াল করা উচিত অতিরিক্ত খাবার খাওয়া হচ্ছে কিনা। অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ আমাদের শরীরের ওজন বাড়িয়ে দিতে পারে ফলে অন্য সমস্যার পাশাপাশি আমাদেরকে কিডনিও আক্রান্ত হয়।
ধূমপান ও অতিরিক্ত এলকোহল থেকে বিরত: শারীরিক সমস্যাকে প্রকট করে তুলে ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ পান। ধূমপান ও অতিরিক্ত মদের ফলে কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। তাই কিডনি ভাল রাখতে চেষ্টা করুন আজ থেকেই ধূমপান ও মদ বর্জন করুন।
প্রয়োজন ছাড়া কোন ওষুধ নয়: আমরা অনেকেই শারীরিক ছোট খাটো কোন সমস্যায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই নিজেরা ওষুধ খাই। কিডনির জন্য এসব ওষুধ কম-বেশী ক্ষতিকর। ফলমূল এর পাশাপাশি সম্ভব হলে সামুদ্রিক মাছ, কালো ফল, শাক-সবজি, শিম ও নানান ধরনের বাদাম কিডনিকে পুষ্টি সরবরাহ করে। সামুদ্রিক খাবার যেমন মাছ, সী-উড, কেল্প ও কিডনি শক্তিশালী করার জন্য খুব প্রয়োজনীয়।

বাংলাদেশে কিডনি রোগীর অবস্থা – কিডনি নষ্ট হলে ডায়ালাইসিস করে চিকিৎসা করার সামর্থ্য বাংলাদেশে ১০ শতাংশেরও নেই। সচেতন হলে স্বল্প ব্যয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমান ধারায় কিডনি রোগী বৃদ্ধি পেলে ২০২০ সালে বাংলাদেশে তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষ ক্রনিক কিডনি রোগে আক্রান্ত হবে বলে জরিপে জানা গেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে দুই কোটি লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার রোগী ধীরগতিতে কিডনি অকেজো হয়ে প্রতিবছর অকালে মৃত্যুবরণ করে।

কিডনি রোগ সম্পর্কে জানুন, সতর্ক থাকুন এবং প্রতিরোধ করুন।

(Source- webmd, medicinenet, kedneydoctors)

Jeba Afrin – Techmorich