সিল্ক রোডঃ অনলাইনের এক ভয়ংকর নিষিদ্ধ জগত!

সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৫

প্রতিটি দেশ আর সমাজই ভাল-মন্দ উভয় নিয়ে গঠিত। সমাজে ভালোর জন্য কাজ করে এমন মানুষের সংখ্যা এখন পর্যন্ত বেশি বিধায় আমরা এখনো বেঁচে আছি। প্রতিটা সমাজের একটা অন্ধকার দিকও থাকে। Black market বা কালো বাজার হচ্ছে সমাজের একটা অন্ধকার দিকের উদাহরণ। কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও প্রায় সব দেশ সব সমাজেই মাদক ব্যবসার অবস্থা রীতিমত রমরমা। আক্ষেপ করে অনেকে বলেন “গোয়ালাকে দুধ বিক্রি করতে হয় ঘরে ঘরে ঘুড়ে, আর liqueur বা মদের দোকানে লোকজন নিজ থেকেই আসে”। সমাজ এখন তার পরিধি বিস্তার করেছে খানিকটা। বাস্তব জগতের সাথে ভার্চুয়াল জগত বা ইন্টারনেটও এখন আমাদের সমাজের অংশ। এই ইন্টারনেটেও আছে বাস্তব জগতের মত অন্ধকার জগত বা ব্ল্যাক মার্কেট। আজকে জানব এমনই এক সাম্রাজ্য ও তার কুখ্যাত সম্রাটের কথা।

Silk Road

সিল্ক রোড হচ্ছে অনলাইন এক মার্কেট প্লেস বা বাজারের নাম। বাজার থেকে বা যে কোন ই-কমার্স সাইট থেকে আমরা যে রকম কেনাকাটা করতে পারি তেমনই কিছু সেবা (!) দিত এই marketplace. তবে এর বিশেষত্ব অন্যদের থেকে আলাদা। এই বাজারটি বিখ্যাত হয়েছিল সকল নিষিদ্ধ পণ্যের কেনাবেচার জন্য।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই anonymous market এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন Ross William Ulbricht. একই বছরের জুন মাসে Nick Denton এর ব্লগ Gawker এ এই সাইটের উপর একটি আর্টিকেল পোস্ট করা হয় । এর ফলে সাইটের ভিজিটর বেড়ে দাঁড়ায় কয়েক গুণ! এক সময় গোপনে এই সাইটের কার্যক্রম চলতে থাকলেও আস্তে আস্তে এটি সবার কাছেই প্রকাশ পেয়ে যায়। এমন কি মার্কিন সিনেটর Charles Schumer তাদের বিচার বিভাগ ও DEA (Drug Enforcement Administration) কে সাইটটি বন্ধ করে দিতে বলেন।

২০১৩ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ান এক কোকেইন ডিলার (cocaine dealer) সর্বপ্রথম সিল্ক রোডের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তিনি এই মার্কেট প্লেসের মাধ্যমে cocaine এবং MDMA কিনেছিলেন। পুলিশ উক্ত কোকেইন ডিলারের কম্পিউটারে থাকা একটা ছবিতে তার সিল্ক রোডের আইডি (alias) খুঁজে পান। অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ আর DEA যৌথ ভাবে কাজ করছিল এই কেসটির ব্যাপারে। তারা সিল্ক রোডের ব্যবহারকারীদেরকে টার্গেট করে তাদেরকে গ্রেফতার করত। একই বছরের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ডে ১৫ গ্রাম methamphetamine আমদানী করার অপরাধে এক ব্যক্তিকে ২ বছর ৪ মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়।

একই সাথে চলতে থাকে সাইটটিকে বন্ধ করার অর্থাৎ এর মূলে আঘাত করার প্রচেষ্টা। DDoS আক্রমণের ফলে ২০১৩ সালের জুন মাসে কিছু দিনের জন্য বন্ধ হয়ে থাকে Silk Road. এরপর আবার ফিরে আসে নতুন উদ্যোমে। অবশেষে ২রা অক্টোবর ২০১৩ সালে এই কালো সাম্রাজ্যের কুখ্যাত সম্রাট  Ross William Ulbricht (Founder and owner of Silk Road) গ্রেফতার হন এবং সে সময়ই বন্ধ করে দেয়া হয় সাইটটি। FBI তাকে San Francisco Public Library এর একটি শাখা Glen Park Library থেকে আটক করে। চার্জশিটে তার নামে মানি লন্ডারিং, computer hacking, অবৈধ মাদক দ্রব্যের বিস্তার ও ৬ জন মানুষকে হত্যার চেষ্টা করার অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়। FBI সিল্ক রোডের অনুসন্ধান সম্পর্কে বলেছিল যে তারা উক্ত সাইটে থাকা CAPTCHA এর মাধ্যমে মূল server এর Real IP এর সন্ধান বের করেন। ধারণা করা হচ্ছে ক্যাপচাটি হয়ত কোন ভাবে সাইটের মূল সার্ভারের সাথে সম্পর্কিত ছিল বা সাইটে এমন কোন নিরাপত্তা ত্রুটি ছিল যার ফলে এই CAPTCHA input এর মাধ্যমে এফবিআই এর কাছে সার্ভারের তথ্য উন্মোচিত হয়ে পড়ে। কিন্তু cyber security expert-রা বলছেন সিল্ক রোডের লগ ইন পেজের PHP ফাইলে থাকা $_SERVER variable এর মাধ্যমে সার্ভারের তথ্য বের করা হয়েছে। সার্ভার সম্পর্কিত তথ্য ধারণ করে এই ভেরিয়েবলটি। যার মান হয়ত কোন ভাবে প্রিন্ট করার ব্যবস্থা করা করেছিল।

সিল্ক রোডের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক Ulbricht এর ২৬০০০ বিটকয়েন বাজেয়াপ্ত করে FBI. যার তৎকালীন বাজার মূল্য প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সাইট সম্পর্কে Ulbricht বলেন যে, তিনি এর মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতা ও তাদের ইচ্ছার মূল্যায়ন করতে চেয়েছিলেন। মানুষ যেন তার পছন্দ মর স্বাধীন ভাবে চলতে পারে। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এটা খুব বড় ধরণের ভুল কাজ ছিল।

Manhattan এর Federal Court এ Ulbricht এর বিচারকার্য শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি। দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরে ৪ ফেব্রুয়ারি আদালত তাকে মানি লন্ডারিং, মাদক বিপনণ, কম্পিউটার হ্যাকিং সহ ৭টা অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। শাস্তি স্বরুপ তাকে দেয়া হয় ৩০ বছরের কারাদন্ড।

শেষ হয়েও শেষ হল না সিল্ক রোডের গল্প

সিল্ক রোডের কর্তা Ross William Ulbricht এর কারা জীবন শুরু হবার মধ্য দিয়ে সিল্ক রোডের গল্প শেষ হতে পারত। কিন্তু শেষ হল না। একটা অপরাধ তার সাথে আরো মানুষকে অপরাধী করে তোলে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। চলতি বছরের ১৫ মার্চ সিল্ক রোড তদন্তের সাথে জড়িত থাকা দুইজন প্রাক্তন federal agent-কে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ নামায় আসামীপক্ষের থেকে অর্থগ্রহনের কথা উল্লেখ আছে।

এর থেকেও বড় ঘটনা ঘটান federal task force এর একজন সদস্য Shaun Bridges. তিনি সিল্ক রোডের একাউন্ট থেকে গায়েব করে দেন ২০,০০০ bitcoin. যার মূল্য ৮২০,০০০ মার্কিন ডলার! তদন্ত চলাকালীন সময়ে তিনি সিক্ল রোডের একাউন্ট থেকে এই অর্থ নিজের একাউন্টে সরিয়ে ফেলেন। গত ৩১ আগস্ট ২০১৫ তারিখে আদালত তাকে মানি লন্ডারিং ও আইন অমান্যের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। তার অপরাধ প্রমাণিত হলেও এখনো রায় ঘোষণা করা হয় নি। এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে এই বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত।

নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্য, অবৈধ অস্ত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, চুরি যাওয়া ক্রেডিট কার্ড, শিশুপর্ন থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরণের নিষিদ্ধ জিনিসের বাজার ছিল সিল্ক রোড। যদিও তারা একই সাথে বৈধ ভাবে বিভিন্ন বই বা শিল্পকর্মও বিক্রি করত। সিল্ক রোড বন্ধ হলেও এমন ব্ল্যাক মার্কেটের সংখ্যা ইন্টারনেট বিশ্বে নেহাত কম নয়। আমাদের সমাজ, পরিবার ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে এসকল প্রযুক্তির ভয়াল থাবা থেকে নিরাপদে রাখার জন্য সচেষ্ট হতে হবে সরকার ও আমাদের নিজেদেরকেই। পারিবারিক বন্ধনকে গড়তে হবে অনেক দৃঢ় ভাবে। নৈতিকতার ভিত্তিটা হতে হবে মজবুত!

Tech Analyst – Techmorich